এরশাদ শিকদারের জীবনী
এরশাদ শিকদারের জীবনী
বাংলাদেশের ইতিহাসের যতগুলো কুখ্যাত দুর্ধর্ষ খুনী সন্ত্রাসী ছিলেন তার মধ্যে এরশাদ শিকদার এর নামই হয়তো প্রথমে আসবে। তিনি ছিলেন ভয়ানক এক পৈচাশিক সিরিয়াল কিলার। ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতেন তিনি। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী তিনি প্রায় ৬০ টির মত খুন করেছেন। আর তার প্রতিটি হত্যাকান্ডের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ভয়াবহ নির্মমতা, নাটকীয়তা ও বর্বরতা। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ২০০৪ সালের ১০ই মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরশাদ শিকদার আমাদের মাঝে না থাকলেও আমাদের মাঝে আছে তার বানানো সেই বিলাসবহুল বাড়ি "স্বর্ণকমল"। এই বাড়িটির কথা হয়তো অনেকেরই খুব ভালো একটা মনে নেই, কিন্তু অনেকের ই বাড়িটির সাথে ভয়ঙ্কর নির্মম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই বাড়িটিকে দেখলে হয়তো অনেকেরই মনে পড়ে যায়, এরশাদ শিকদার এর মত দুর্ধর্ষ, ভয়ংংকর এক বর্বরোচিত পৈচাশিক ও স্বৈরাচারী খুনীর মনোবৃত্তির কথা। কিভাবে না ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী, আস্তে-ধীরে রয়ে সয়ে মানুষ খুন করতেন তিনি। সেই বর্বরতম ঘটনার বিবরণ শুনলে যে কারো গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাবে।
এরশাদ শিকদার ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদার ঘোনা গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল বন্দে আলী শিকদার। তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। আর তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। তাদের পরিবারে অভাব-অনটন সবসময় লেগেই থাকত। ১৯৯৬৬-৬৭ সালেতর দিকে অভাবের তাড়নায় এরশাদ শিকদার মাত্র ৭/৮ বছর বয়সে চলে আসেন খুলনার ঘাট এলাকায়। সেখানে কুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন। বেশ ভালোই কাজ করছিলেন তিনি। তবে কুলির কাজ করতে গিয়ে চুরির অভ্যাস হয়ে যায় তার। কুলির কাজ করার সময় সে সরকারি ট্রেন ও বার্জ্য কার্গো থেকে চাল,গম, কাঠ ইত্যাদি চুরি করা শুরু করে। চুরি করতে গিয়ে বহুবার মানুষের হাতে ধরা খেয়ে মার খেয়ে ছিলেন তিনি কিন্তু চুরি করা বাদ দেননি।
শেষে তার নাম হয়ে যায় "রাঙা চোর"। কারন তার গায়ের রঙ ছিল খুবই ফর্সা। চুরি করতে করতে এক সময় তিনি চোরের সর্দার হয়ে ওঠেন। ২৯৭৪ সালের তিনি তার আপন বড় আশরাফ আলী তাকে ১টি ট্রলার ও ২২ টি মাছ ধরার জাল দেন মাছের ব্যবসা করার জন্য। সে ববসা করার পাশাপাশি চুরির কাজও ভালভাবেই চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭৭ সালে সে একটি দল গঠন করেন যার নাম ছিল রামদা বাহিনী । তখন তার চুরি করার এলাকার পরিধি আরো বেড়ে যায়।
এক এক করে তিনি প্রায় সব ধরনের অপকর্ম করা শুরু করে। খুলনার ঘাট এলাকা ও রেল স্টেশনে ডাকাতী, চোরাচালানী, ছিনতাই জোরপূর্বক জবর দখল করা চাঁদাবাজি ইত্যাদি কোন কাজই। বাদ দিত না সে। এরশাদ শিকদার ১৯৮২ সালের দিকে ঘাট এলাকা দখল করে নেয়,এরপর সেখানে শুরু হয় তার একচ্ছত্র ক্ষমতার দাপট।
আশির দশকে এরশাদ শিকদার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে। এক সময় তিনি ওই এলাকার কমিশনার নির্বাচিত হন। তখন এরশাদ শিকদার ক্ষমতা যেন আরো বহুগুণ বেড়ে গেল তখন খুলনার সারা শহর জুড়ে তিনি মদ গাঁজা হেরোইন ফেনসিডিল সহ সব ধরনের নেশা জাতীয় পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। ক্ষমতার প্রভাবে এরশাদ শিকদার তখন সরকারি জমি জমি দখল করে বসতে বানিয়ে দেয়। সে বস্তিতে তখন হাজার হাজার লোক বসবাস করছিল। আর তাদের মধ্যে অনেকেই এরশাদ শিকদারের সাথে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
৯০ দশকের শুরুর দিকে তিনি এক লোককে ভয় দেখিয়ে তার থেকে একটি বরফ কল দখল করে নেন। আর এই বরফ করেই তিনি গড়ে তোলেন ত্রাসের আখড়া। এরশাদ শিকদারের যারা অত্যাচারের শিকার হতো তাদেরকে এই বরফ করেই বসেই নির্যাতন করা হতো, এমনকি অনেককেই এই বরফ কলে বসে মেরেও ফেলা হত।
এরশাদ শিকদার একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে মানুষ খুন করতেন। যাকে মারা হতো তাকে প্রথমে তার সামনে হাত পা বেঁধে শোয়ানো হত। তারপর তাকে তিনি ইচ্ছা মতো পেটাতেন, তিনি ততক্ষণ পেটাতেন যতক্ষণ তার হাড়গোড় ভেঙে না যায়। তারপর শিকারের গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হতো। এরপর শুরু হতো এরশাদ শিকদারের পৈচাশিক বর্বরতম মরন খেলা। লাশের বুকের উপরে উঠে উঠে তিনি লাফাতে থাকতন।আর পাঁজরের হাড় ভাঙ্গার আওয়াজ কান পেতে শুনতেন। শেষ মৃত ব্যক্তির লাশ একটি বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দিতেন। তার পর পবিত্র হওয়ার জন্য দুধ দিয়ে গোসল করে উঠতেন। একবার ভেবে দেখুন তো কতটা নাটকীয় ভাবে নির্মমভাবে এরশাদ শিকদার হত্যাযজ্ঞ চালাতো, যা কোন ছবির কাহিনীকেও হার মানায়। আরো শোনা যায়, তিনি নাকি ১০ থেকে ১২ ফিটের একটি পুল বানিয়ে ছিলেন এবং সেখানে রক্তপিপাসু মাগুর মাছ চাষ করতেন সেই পুকুরে অনেক সময় বিভিন্ন মানুষকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে মাগুর মাছ কে খেতে দিত। এভাবেই চলতে থাকে তার ত্রাসের রাজত্ব।
এরশাদ শিকদার অবৈধ উপায়ে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। আর এই অবৈধ টাকা দিয়ে তিনি খুলনার মাজীদ সরণিতে গড়ে তোলেন এক বিলাসবহুল বাড়ি "স্বর্ণকমল"। বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় দেশি-বিদেশি সব দামি পাথর। তাছাড়া বাড়ি তৈরীর সকল সরঞ্জাম তিনি ভারত থেকে এনেছিলেন। বাড়ির দোতলায় ওঠার জন্য একটি প্যাচানো সিড়ি বানানো হয়েছিল। দুতলার অপর পাশে ছিল গোপন একটি সিঁড়ি যা এরশাদ শিকদার পালানোর কাজে ব্যবহার করত। সিঁড়ির দুই পাশে ব্যবহার করা হয়েছিল দামী দামী সব কাঠ। পুরো ঘরটি জুড়ে ছিল দেশি-বিদেশি আসবাবপত্র ও শোপিস।এরশাদ শিকদার এই বাড়িটি নকশা ভারত থেকে করে এনেছিলে। শোনা যায় তৎকালীন সময়ে এই স্বর্ণকমল বাড়িটি ছিল খুলনা অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি। এই বাড়িটি কেও ঘিরে রয়েছে এক নির্মম হত্যার কাহিনী। কথিত আছে,এই বাড়িটি নির্মাণের সময় অন্যের জমিতে এক ইঞ্চি পরিমাণ ঢুকে গিয়েছিল, যার কারনে এরশাদ শিকদার তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী তিনি ৬০ জনের মত মানুষকে খুন করেছিলেন, আরো অনেক বেশি হবে কিন্তু একটি গোপন সূত্রে জানা গেছে এই খুনের পরিমাণ আরো বেশী হবে। এরশাদ শিকদারের মোট ৬ জন স্ত্রী ছিলেন। এরশাদ শিকদার ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। আদালতে এরশাদ শিকদারের বডিগার্ড নুরে আলম রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। নূর-ই-আলম আদালতে চব্বিশটি খুনের সাক্ষ্য দিয়েছিলে। নূরে আলমের মনেও অনেক ক্ষোভ ছিল কারণ এই নূরে আলমের স্ত্রীর উপর এক সময় এরশাদ শিকদার নির্যাতন চালিয়েছিল। নূর-ই-আলম শুধু চুপ করেছিল আর সুযোগের অপেক্ষা করছিল।
এরশাদ শিকদারের নামে মোট সতেরোটি খুনের মামলায় ৫ টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৬ টিতে ফাঁসির রায় হয়। তিনি প্রাণ ভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ছিলেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করেনি। এরশাদ শিকদার ভেবেছিলেন তার ক্ষমতা আর টাকার জোরে তিনি মাহফিলের যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
অবশেষে ২০০৪ সালের ১০ই মে রাত বারোটা এক মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এরশাদ শিকদারের লাশ দাফন করা হয় টুটপাড়া কবরস্থানে।