পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের শেষ পরিণতি।
১৭৫৭ সালের ২৩ ই জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তার কাছের মানুষদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে। সিংহাসন হারান। যার ফলে বাংলার আকাশ থেকে স্বাধীনতার সূর্য প্রায় একশত নব্বই বছরের জন্য অস্তমিত হয়ে যায়। শুধু তাই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে শহরের রাস্তায় রাস্তায় দেহটাকে ঘোরানো হয়। অবশেষে তার ক্ষতবিক্ষত দেহ খোশবাগ নামক স্থানে দাফন করা হয়। বিশ্বাসঘাতকদের নেতা মীর জাফর আলী খান সম্পর্কিত তিনি সিরাজউদ্দৌলার খালু হন। তার কাছের মানুঢদের মধ্যে আরেকজন আরেকজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন তার আপন খালা ঘসেটি বেগম। ক্ষমতা আর সম্পদের লোভ তাদেরকে পেয়ে বসেছিল। তাই তারা নবাব কে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। নবাব সিরাজের পরাজয়ের পরে বাংলাতে কিভাবে শাসন ও শোষণ করা হয়েছে তা আমরা কম বেশী সবাই জানি। আমরা আজ সেদিকে যাব না, আমরা আজকে আলোচনা করব পলাশীর যুদ্ধে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল সেই বিঢয় নিয়ে। তাদের শেষ পরিণতি খুব ভয়াবহ ও নির্মম হয়েছিল।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা ছিলেন নবাব আলীবর্দী খান। তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে খুবই ভালো বাসতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই সিরাজকে অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী ও রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। নবাব আলীবর্দী খান মারা যাওয়ার আগে সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব করে যান। আলীবর্দী খান মারা যাওয়ার পর বাংলার মসনদে বসেন সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু এই বিষয়টা সহজেই মেনে নিতে পারেনি রাজমহলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ।মীরজাফর। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার জন্য বেশ কয়েকজন মিলে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠ,খালা ঘসেটি বেগম,উমির্চাদ,ইয়ার লতিফ খা, রাজা নন্দ কুমার সহ প্রমুখ।
![]() |
নবাব ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য ১৭৫৭ মীরর জাফরের ছেলে মীরনের বাড়িতে বসে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তিতে বলা হয়, মীর জাফর ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করবে না কিন্তু নবাবের সৈন্যরা যেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরতে পারে সেই ব্যবস্থা তিনি করবেন। ঠিক তসি হলো।
ষড়যন্ত্রের কারণস্বরূপ ১৭৫৭ সালের ২৩ই জুন পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সাথে নবাবের যুদ্ধ বাঁধে। নবাবের পক্ষে বিপুল গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র ও ৫৩ হাজার সৈন্য সামন্ত ছিল। আর বাহিনীর মাত্র ৩০০০ সৈন্য ছিল। সেই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন। কারন যুদ্ধের এক পর্যায়ে মীর জাফর নবাবে যুদ্ধবিরতির পরামর্শ দিয়েছিলেন। নবাব যুদ্ধ বিরতি দিল, এদিকে এদিকে ইংংরেজ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যার ফলে নবাবের স্বল্প কয়েকজন সৈন্যের উপর ইংরেজ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর আবার মীর জাফরের নেতৃত্বে থাকা একজন সৈন্য ও তাদের বন্দুক থেকে বীর গুলি ছোড়েনি। অবশেষে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ বাহিনীর হাতে সেই যুদ্ধে পরাজিত হলেন। অবশ্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন বন্দে আলী, মীর মদন, মোহন লাল সহ কয়েকজন সেনাপতি। সেই যুদ্ধে সেনাপতি মীর মদন মারা গিয়েছিলদন।
আজ পর্যন্ত যারা বেইমানি করেছে ইতিহাস তাদেরকে কোনোদিন ক্ষমা করেনি। পলাশীর যুদ্ধে ও যারা বেইমানি করেছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেনি ইতিহাস। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর পরই মীরজাফরকে বাংলার মসনদে বসায় ইংরেজরা। ইংরেজরা শুধু তাকে পুতুলের মতো বসিয়ে রেখেছিল কিন্তু বাকি সব ক্ষমতা ছিল তাদের হাতে। মীরজাফরকে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কার করা হয় কয়েক বছর পরেই। মীরজাফর ধীরে ধীরে মদ আর আফিমের নেশায় আসক্ত হয়ে ওঠে। এক সময় মীরজাফর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। তার সারা শরীর ফোড়া ও ঘা হয়ে ভরে যায়। তার সারা শরীর থেকে অবিরত পুজ ও রক্ত পরত। তার সমস্ত শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। পরিবারের লোকজন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাকে একটি জন মানুষহীন জঙ্গলে ফেলে আসে। কে নাকি বলে কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোয়া পানি খাওয়ালে নাকি মীর জাফরের এই রোগ ভাল হয়ে যাবে। সেই পানিও খাইয়েছিলেন রাজা নন্দকুমার। শেষ মেশ তাকে বাচানো সম্ভব হয়নি। অসহ্য যন্ত্রণায় ধুকতে ধুকতে মীরজাফরের অবশেষে নির্মমভাবে মৃত্যু হয়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ,যখন সে সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল।
মীর মিরন ছিলেন মীর জাফরের বড় ছেলে। সে অগাধ স্বাধীনতা পেয়ে খুবই উৎশৃংখল ও বিলাসী হয়ে উঠেছিলেন। সে তার বাবার মতোই নিচু স্বভাবের হয়ে উঠেছিলেন। এমন কোনো পাপ কর্ম নেই যা তিনি করতেন না। এই মীর মিরনই ছিলেন নবাবা সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার মূল নায়ক। তার হুকুমেই মোহাম্মদ আলী বেগ নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এই কুলাংগারের নাকি বর্জপাতে নির্মমভাবে মৃত্যু হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাস বিদগন বলেন। আবার ঐতিহাসিক গন বলেন, মীর মীরন নাকি এত মাত্রায় উৎশৃংখল হয়ে উঠেছিলেন যে, কোন এক ইংরেজ সেনাপতির তাকে থামানোর জন্য গুলি করে হত্যা করে। অনেক ইতিহাসবিদগণ এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, মিরনকে মেজর ওয়ালস তার উশৃঙ্খলতার জন্য হত্যা করেছিলেন। সত্য ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নাকি মিরনের মৃত্যু বজ্রপাতে ঘটেছে বলে প্রচার করে বেরিয়েছে।
মীর কাসিম ছিলেন মীর জাফরের মেয়ে জামাই। বলা হয়, এই মীর কাসেমই ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরে বাংলার স্বাধীন চেতা নবাব। তিনি ইংরেজদের সমস্ত চক্রান্ত বুঝে ফেলেছিলেন। মীর কাসিম তার শ্বশুর অর্থাৎ মীরজাফরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেই মসনদে নবাব হিসেবে বসেছিলেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘোড় বিরোধিতা করতেন সব সময়। তারই জের ধরে ইংরেজদের সাথে তার যুদ্ধ বাঁধে। এই যুদ্ধই বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। সেই বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে মীর কাসেম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এর পর মীর কাসেম বাংলা থেকে পালিয়ে যায়। তার পর নাকি তিনি দিল্লির পথে পথে ঘুরতে থাকেন। একদিন সকালে নাকি দিল্লির মুঙ্গের দুর্গের সামনে মীর কাসেমের মৃত লাশ পরে থাকতে দেখে অজ্ঞাত পথচার্যিরা। মীর কাসেমের মাথার কাছে নাকি একটি চিরকুট পাওয়া যায়। আর এই চিরকুট থেকে জানতে পারা যায়, এই মৃত ব্যক্তিই হলেন মীর কাসেম আলী খান বংলার ভবিষ্যৎ স্বাধীন চেতা নবাব।
নবাব সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় নদীর পানিতে ডুবিয়। আর তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঘসেটি বেগমের আপন বোনের ছেলে মীর বিরণ, যিনি নবাব সিরাজের খালাতো ভাই ছিলেন। এই ঘসেটি বেগমও নবাবের আপন খালা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য এবং তাকে হত্যা করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।
ইয়ার লতিফ খান নাকি হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় যুদ্ধের পর পর। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ইয়ার লতিফ খা কে হত্যা করা হয়েছিল যুদ্ধের পর পরই। কিন্তু অনেকেই হয়ত তার খোঁজ পাননি।
মহা রাজা নন্দকুমার নাকি তহবিলের দেখাশোনা করতেন এবং হিসাব নিকাশ রাখতেন। তিনি নাকি সেই তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন। সেই অভিযোগেই নাকি তাকে ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
পলাশী যুদ্ধের পর নাকি রবার্ট ক্লাইভ উমির্চাদের সাথে প্রতারণা করে ২০ লাখ টাকা মেরে দিয়েছিলেন। যার কারন স্বরুপ সে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে তাকে। শেষে নাকি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে নির্মমভাবে উমির্চাদের মৃত্যু হয়।
মীর জাফরের পুত্র মির মিরনের নির্দেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেছিলেন মোহাম্মদ আলী বেগ। জানা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলা অনুমতি চেয়েছিলেন মৃত্যুর আগে দুই রাকাত নামাজ পরার জন্য। হাতে সময় নেই বলে কুখ্যাত মোহাম্মদী বেগ নির্মমভাবে সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। অথচ এই মোহাম্মদ আলী বেগ ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালিত ভাই। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে এই মোহাম্মদী বেগ কে লালন পালন করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মা বাবা। মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদে অত্যন্ত ধুমধামের সাথে এই মোহাম্মদী বেগের বিয়ে দেওয়া হয়। হায় হতভাগা মোহাম্মদী বেগ, কারাগারে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মাত্র ১০০০০ টাকার লোভে নির্মমভাবে হত্যা করে। অবশেষে মোহাম্মদী বেগ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কুপের পানিতে বিনা কারনে ঝাঁপ দিয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে।
বার্ধক্যজনিত কারণে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে ওয়াটসনের। তার স্বাস্থ্যের এমন অবনতি হয় যে কোনো ওষুধেই তার ভালো ফল পায় না। অবশেষে কলকাতার মাটিতেই অয়াটসনের করুণভাবে মৃত্যু হয়।
বাংলার বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি চুরি করে বিলেতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ক্রাফটন। তখন জাহাজ ডুবে অসহায় ভাবে এই ক্রাফটনের অকালই মৃত্যু ঘটে।
পলাশীর যুদ্ধের পর রায় দুর্লভ কে তার বেঈমানীর জন্য কারাগারে বন্দি করে রাখেন মীর কাসিম। সেই কারাগারে বন্দী অবস্থায়ই রায় দুর্লভ ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেন।
জগৎশেঠ কে তার বেঈমানীর জন্য কঠিন শাস্তি দিয়েছিলো মীর কাসিম। মীর কাসিম জগৎশেঠ কে দুর্গশিখর থেকে ফেলে দেন পদ্মার পানিতে, যার তার ভয়াবহ মৃত্যু ঘটে।
পলাশীর যুদ্ধে চক্রান্তের মাধ্যমে জয়ী হওয়ার ফলে বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা কামিয়ে নিয়েছিল এই রবার্ট ক্লাইভ। ইংরেজরা তাকে আখ্যা দিয়েছিল "গ্লাসি হিরো" বলে। মীরজাফর ও তার ছেলেকে বাধ্য করেছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি জঘন্য আচরণ করতে। মোহাম্মদী বেগ যেন নবাবকে হত্যা করে এইজন্য মিরনকে টাকা দিতে বলেছিল এই রবার্ট ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভ বাংলা থেকে অর্থ লুন্ঠনের ফলে বিলেতে দুর্নীতি মামলায় জেল খেটে ছিল। শেষে আত্ম সম্মান বাঁচাতে রবার্ট ক্লাইভ বাথরুমে ঢুকে গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরন করেন।
পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের ফল কখনোই শুভ হয় না। বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি সবসময়ই মর্মান্তিক ও করুন হয়ে থাকে।

oh god .....